Last updated on June 22nd, 2020 at 12:30 am
‘ঈদ’ মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। দীর্ঘ প্রায় ১ মাস সিয়াম সাধনার পরে যেমন আসে ঈদ-উল-ফিতর, অপরদিকে মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালার জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রত্যয়ে আসে ঈদ-উল-আযহা। ঈদ অর্থ আনন্দ আর আযহার শব্দের অর্থ কোরবানী অর্থাৎ উৎসর্গ করা। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তা’লার আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে প্রাণপ্রিয় জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে তাঁর (হযরত ইসমাঈলের) পূর্ণ সম্মতিতে কোরবানী করতে উদ্যত হন (৩৭ঃ ১০২, ১০৭)। মক্কার নিকটস্থ ‘‘মীনা’’ নামক স্থানে ৩৮০০ (সৌর) বছর পূর্বে এ মহান কোরবানীর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে তাঁর পুত্রের স্থলে একটি পশু কোরবানী করতে আদেশ দেন। আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য ও নজিরবিহীন নিষ্ঠার এ মহান ঘটনা অনুক্রমে আজও মীনায় এবং মুসলিম জগতের সর্বত্র আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানীর রীতি প্রচলিত রয়েছে। ঈদের দিনে গোটা মুসলিম জাতি মহা আনন্দে মেতে উঠে। তবে উপলক্ষ এক হলেও আনন্দের ও অনুভূতির রয়েছে ভিন্নতা।
বয়সভেদে ঈদ আনন্দ
ছোটবেলার ঈদ। জন্ম আমার শহরে হলেও, আমি মোটামুটি যখন ৮/৯ বছরের ছেলে, তখনই গ্রামে চলে আসি। বলা যায়, তখন থেকে কৈশোর পর্যন্ত গ্রামেই কাটিয়েছি। ২৯ রোজার দিন, সন্ধ্যাবেলায়। ইফতার শেষে কিংবা মাগরিবের পরেই পাড়ার বন্ধুরা দৌড়ে ছুটে যেতাম এদিক ওদিক। কোথাও থেকে চাঁদ দেখা যায় কিনা। চলে যেতাম বাড়ি থেকে খোলা মাঠে, মাঠ আমাদের বাড়ির পাশেই। মাঝে মাঝে তো এশার নামাজের পরেও চাঁদ খোঁজে বেড়াতাম। চাঁদ মামার দেখা না পেলে বাসায় এসে মন খারাপ করে বসে থাকতাম, এত্তো আশা নিয়ে গেলাম, এই হল! পরের দিন (৩০ রোজার দিন, সন্ধ্যায়), আবারও চলে পূর্বের দিনের মত ছোটাছুটি। ঐ দিন অবশ্য চাঁদ মামার দেখা মেলে যায়। চাঁদ দেখার মুহূর্তে আমরা সবাই মোনাজাত করতাম, ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতাম, আল্লাহ্ চাঁদ মামাকে দেখাইয়া দাও, আল্লাহ্ আল্লাহ্’ দোয়ার কথাগুলো ছিল অনেকটা এরকম। আবার অনেক সময় আমরা এক ধরণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম। এই যেমন, যে আগে চাঁদ দেখবে তাকে সবাই খাওয়াবে। যখনই চাঁদ দেখতে পেতাম ওমনি হুররাহ! সে কি যে চিৎকার, উল্লাস! মনে হতো, এই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্জন, পাওয়া। সবচেয়ে বেশি আনন্দ বুঝি এই চাঁদ দেখাতেই! এছাড়া ঈদের দিন ছিল সালামী নেওয়ার পালা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বন্ধুরাসহ সোজা নদীতে যেতাম, নদীও খুব কাছেই। ঝাপাঝাপি করে গোসল করা। বাসায় এসেই হালকা সেমাই খেয়ে নতুন কাপড় পড়েই আব্বু, আম্মু, দাদু, বাড়ির সবাইকে সালাম করতাম। কারণ ছোট থেকেই দেখতাম অন্যরা সালাম করে, সাথে উদ্দেশ্য ছিল, সালামী পাবো। সালামী পর্ব শেষ করে গুনতাম কত টাকা পেলাম। সেটা আবার অন্য বন্ধুদের সাথেও মিলিয়ে দেখতাম, কে কত পেল। নতুন কাপড় পড়ার জন্য ঈদের দিনের আগে থেকেই মুখিয়ে থাকতাম। কখন ঈদের কাপড় পড়বো, সেটা আবার কাউকে ঈদ এর আগে দেখাতাম না, কারণ আগেই দেখিয়ে ফেললে আর ঈদ এর মজাই থাকবে না। ঈদগাহে যেতাম আব্বুর সাথে, দাদা, চাচ্চুদের সাথে। তারা যা যা করতো দেখে তাই তাই করতাম ঈদগাহে নামাজের সময়। নামাজ শেষে পরম আনন্দে কুলাকুলি করা ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার, সবাইকে ঈদ মোবাররক বলাটার মধ্যে ছিল এক অন্যরকম অনুভূতি। কে কত পেল। এখন বয়স বেড়েছে, ছোট – কৈশোর থেকে যুবক। এখন আর তেমন অনুভূত হয় না। এখন আর চাঁদ মামা দেখার আশায় এদিক ওদিক ছোটাছুটি করা হয় না, হয় না ওরকম উল্লাস কিংবা চিৎকার মেরে উঠা, হয় না চাঁদ দেখার জন্য বন্ধুদের নিয়ে দৌড়ে কোথাও ছুটে বেড়ানো। এমনকি চাঁদ আগে দেখার জন্যে খাওয়ার ব্যাপারটিও এখন আর নেই। এখন শুধু টিভির পর্দা কিংবা মসজিদের মাইকের আওয়াজের অপেক্ষা, কখন বলবেন যে, পবিত্র যিলক্বাদ মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। আগামীকাল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। হয়তো মাঝে মাঝে চাঁদ দেখার জন্য বাসার ছাদে যাওয়া হয়, সেটাও খুবই কম। কিন্তু ছোটবেলায় কিন্তু চাঁদ দেখার জন্য ছোটাছুটি করা কখনও বাদ পড়তো না।
আবার কোরবানী ঈদে, ঈদগাহ্ থেকে নামাজ শেষ করে কখন যে বাসায় ফিরবো, সেটার জন্য মন ছটফট করতো। কারণ, গরু/মহিষ জবাই না দেখলে তো ঈদ-ই হবে না। বাসায় এসেই কিছু খেয়ে বা না খেয়েই দিতাম ভোঁ দৌড়। আমাকে আর ঠেকায় কে, কোরবানী তো দেখতেই হবে। কোন গরু কিংবা মহিষ কে জবাই করতে কেমন বেগ পেতে হল। এখন যখন ছোটদের ঈদ আনন্দ দেখি, ভাবি আহা কি আনন্দ ওদের মাঝে। আমরাও তো করতাম। আহা, কি আনন্দ!
স্থানভেদে ঈদ আনন্দ
২০১০ এর শেষ কিংবা ২০১১ এর প্রথম দিকে আমি চলে আসি নিজ জেলা শহরে। সুতরাং, শহরের ঈদ আনন্দ বা অনুভূতিগুলোও কাছ থেকে দেখার, উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে। যা দেখলাম, ঈদ আনন্দ জায়গা ভেদেও ভিন্ন হয়। স্থানভেদেও রয়েছে ভিন্ন আমেজে ঈদ এর ভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ। গ্রামের যে ছোট্ট ছেলেটি দলবেঁধে দৌড়ে চলে যায় খোলা মাঠে, অনেকে এক সাথে চাঁদ দেখতে, সেখানে শহরের ছোট্ট ছেলেটি হয়তো যায় বাসার ছাদে, কখনও কখনও একা, আবার কখনও কখনও বাসার মানুষদের সাথে। শহরের ছোট্ট মণিদের যাওয়া হয় না খোলা মাঠে কিংবা দাপাদাপি – ঝাপাঝাপি করা হয় না নদীর পানিতে। ওদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না, দলগতভাবে বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করার দৃশ্য। ঈদ এর দিনে ওরা আব্বু/দাদুর সাথে ঈদগাহে গিয়ে নামাজ আদায় শেষে কিছু জনের সাথে কুলাকুলি, পরে বাড়িতে ফিরে আসা। বিকালে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। এই হচ্ছে ওদের ঈদ আনন্দ। এটা আবার অন্য ধরণের আনন্দ। তাতে কি, ঈদ এর আনন্দ বলে কথা। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হয়তো ভিন্ন। কিন্তু ঈদ আনন্দ!
আবার কোরবানী ঈদেও শহরের ছোট্ট ছেলেটি পাড়ায় ছোটাছুটি করে কোরবানী দেখার সুযোগ হয়তো হয় না। কিন্তু তারা আনন্দটি অন্যভাবে করে। কিন্তু আনন্দ তো আনন্দ-ই। সেটি ঈদ আনন্দ।
আনন্দের ধরণ ভিন্ন হলেও উপলক্ষ কিন্তু একই, ‘ঈদ’। এ যেন এক ভিন্ন আমেজে বৈচিত্র্যময় ‘ঈদ’!
2 Comments
সেই ছেলেবেলা! অসাধারণ কিছু স্মৃতি ছিল ভাই। লেখাটি পড়ে খুব মনে পড়ে গেলো, সেই দিনগুলোর কথা। খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন ভাই।
ধন্যবাদ।